বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প বর্ষায়

 বর্ষায় 


 সন্ধ্যার পূর্ব হইতেই বৃষ্টি নামিয়াছে , আড়া জমিল না । তিন জনে ছাড়া - ছাড়া ভাবে সময় কাটাইতেছিল — তারাপদ তাস ঘটিতেছে , রাধানাথ সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখিতেছে , শৈলেন হাত দুইটাকে বালিশ করিয়া চিত হইয়া শুইয়া গুনগুন করিতেছে । তারাপদ বলিল , তােমার মাথার কাছের জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে , শৈলেন । শৈলেন বলিল , আসুক , বেশ লাগছে ; সুবিধে আমার যখন সম্পূর্ণভাবে নিজের আয়ত্তে , তখন ইচ্ছে করেই একটু একটু অসুবিধে ভােগ করার বেশ একটা তৃপ্তি আছে , — রাজারাজড়ার শখ করে হেঁটে চলার মতাে । । রাধানাথ একটি সংক্ষিপ্ত টিপ্পনী করিল , কবি । । তারাপদ বলিল , তা হলে আর একটু অসুবিধের তৃপ্তি ভােগ করতে করতে তুমি । হয় শুভেনকে ডেকে নিয়ে এস , চার জন হলে দিব্যি আরাম করে তাসটা খেলা । যায় ! রাধানাথ বলিল , আমি গিয়েছিলাম তার কাছে ; সে আসবে না । তার দাদার শালা বেড়াতে আসবে । আসুক না ! বললে — এ অবস্থায় আমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়াটা নেহাত অভদ্রতা হবে না ? তারাপদ ভ্ৰ কুঞ্চিত করিয়া বলিল , ও ! অভদ্রতা । । আবার চুপচাপ ; শৈলেন গুনগুনানিটুকুও থামাইয়া দিয়াছে । একটু পরে তারাপদই আবার মৌনতা ভঙ্গ করিল । প্রশ্ন করিল , তােমরা ভালােবাসা জিনিসটায় বিশ্বাস করাে ? রাধানাথ বলিল , যখন ভূতে করি , তখন ভালােবাসা আর কী দোষ করেছে , দুটোই যখন ঘাড়ে চাপবার জিনিস । তবে সব সময় করি না বিশ্বাস । ঘাের অন্ধকার রাত্রি , পােড় বাড়ি কিংবা একটানা মাঠের মাঝখানে একটা পুরােনাে গাছ , একলা পড়ে গেছি — এ অবস্থায় ভূতে বিশ্বাস করি । আর ভালােবাসার কথা , — কবির ভাষায় এ - রকম ‘ অঝোর - ঝরা শাওন - রাতি ' — তােমার চা - টি দিব্যি হয়েছিল , আর ওদিকে বাড়িতে খিচুড়ি আর মাংসের খবর পেয়ে এসেছি , ভবিষ্যতের একটা আশ্বাস রয়েছে , এ - রকম অবস্থায় মনে হচ্ছে যেন প্রেম বলে একটা জিনিস থাকা বিচিত্র নয় . . . এমনকি দাদার নেই - শালির জন্যে একটা বিরহের ভাবও মনে জেগে উঠছে যেন । তারাপদ প্রশ্ন করিল , কবি , কী বলে ? শৈলেন বলিল , আমি যে রয়েছি , আরও প্রমাণ দিয়ে স্পষ্ট করে বলতে গেলে এখন এ ঘরে হাতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি — এটা বিশ্বাস করাে ?

করি বইকি না করে উপায় কী ? বিশেষ করে বুঠিরংটর সঙ্গে সঙ্গে তোমার শৈলেনত্বের প্রমাণ যখন , তা হলে ভালােবাসাকেও বিশ্বাস করতে হবে তােমাদের , কেন না আমি আর ভােলাবাসা সম - হিত , ইংরেজিতে তোমরা যাকে বলবে - co - existent ।

 তারপর তাস ঠকিতে উকিতে বলিল , বট ! তাে তােমার জীবনে যে একটা বস্যা আছে , সে সন্দেহ বরাবরই হয় বটে , তরে আন্টি - শুকদেবের মতাে আমি অ্যান্টি - ক্লাইস্টের নজিরে কথাটা ব্যবহার করলাম — অ্যান্টি - শুকদেবের মতাে তুমি যে বশী - প্রেম নিয়েই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছ , এতটা জানা ছিল না । ব্যাপারটা ভেঙে বলাে একটু । শৈলেন আরম্ভ করিল , বয়স যখন সাত - আটর মাঝামাঝি , সেই সময় আমার ভালােবাসার সূত্রপাত ঠিক কোন লগ্নটিতে আরম্ভ হয়েছিল বলতে পারি না । অনভিজের । কাব্য - কাহিনিতে যা বলেন তা থেকে মনে হয় , ভালােবাসা জীবনের একটা নিৰিষ্ট । রেখা থেকে আরম্ভ হয় , যেমন মাঠের ওপর একটা মনের রেখা কিংবা কোনালের । নাগা থেকে আরম্ভ হয় বাজির দৌড় । ওই যে শােনে - প্রথম দর্শন থেকেই প্রেম , কিংবা হাতের লেখা দেখেই ভালােবেসে ফেলা এসব কথা নিতান্তই বাজে । প্রেমকে । একটি ফল বলা চলে - ওর আরটা পজির এলাকাভুক্ত নয় । তবে যে কেত । মংকটক জমে উঠেছে , আর কবে যে তাকে ঘিরে কচি দলগুলি কুঞ্চিত হয়ে উঠবে । তার হিসেব হয় না ; আমরা যখন টের পাই , তখন যাত্রাপথে অনেক দূর এগিয়েছে । সেটা বিকশিত দলের ব্যাকুল গন্ধের যুগ — 
একদিন ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনতে শুনতে আমি ব্যাপারটুকু সন্ধান পেলাম । সেদিনও বড় সুযোগ ছিল , তড়কাপটার ভাগটা আজকের চেয়েও বরং বেশি । । রাজপুত্র অপকুমার কত দীর্ঘ পথ পেছনে রেখে , কত দীতির পথ সামনে করে । চলেছেন । আহার নেই , নিদ্রা নেই , ভয় নেই , শঙ্কা নেই , শুধু বুকের মধ্যে একটি । কাপের স্বপ্ন । যাত্রাপথের শেষে সাগরের অতল তলে মানিকের তােরণ পেরিয়ে তার । পক্ষিরাজ ঘােড়া পেীছল রাজকুমারী কঙ্কাবতার প্রবাল - পুরার দ্বারে । এতটা হল সাধারণ কথা , যাত্রাপথের দৈনন্দিন ইতিহাস ।
- সেই বিশেষ রাতে অলপকুমার - আমি যখন সোনার কাঠি ইয়ে । তারাপদ প্রশ্ন করিল , তুমি আবার কেমন করে বয়স আর অবস্থা ডিঙিয়ে অরূপকুমার । হয়ে পড়লে ? | শৈলেন বলিল , সাত - আট বছর বয়সের একটা মাত্র বড় সুবিবে এই যে , সে সময় বয়স আর অবস্থা সম্বন্ধে কোনও চৈতন্য থাকে না , সুতরাং যাকে মনে ধরে , নির্বিবাদে ত্যর মধ্যে পান্তরিত হয়ে পড়া চলে । এখন তুমি যে অমুক আর তােমার বয়স যে সাইত্রিশ — এই চেতনা তােমার চারপাশে এত সৃষ্টি করে হেমিকে একান্তপক্ষে তুমি ' করে রেখেছে — একই কাটিয়ে রাজপুত্র - কোটাল - পুত্র হয়ে নেওয়া তাে দূরের |

না । বাপদই করাে ? জাকার ভাষায় ওদিকে উহ ,  ং কয়েলের জন্যে যে নিজের ছেলেবেলা থেকেই ঘুরে আসনে , সেটিও

দুষ্কর হয়ে ওঠ । এই তরলতার জন্যে জীবনের সাত - আট বছরের বয়সটা হল রূপকথারই যুগ , যেমন সাইত্রিশ - আটত্রিশ বছরের সময়টা তার নির্বিকারত্বের জন্যে সাহেব , বড়বাবু প্রভৃতির মধ্যে মুখ বুজে চাকরি করবার যুগL - যাক , গল্পটাই শােনাে ; বর্যা কেটে গেল । বায়ুমণ্ডলের এই ভিজে ভিজে আমেজের ভাবটি যখন কেটে যাবে , তখন আমি গল্পটা যে চালাতে পারব — এতে সন্দেহ আছে , কেন না তখন নিজে যা বলছি তা নিজেই বিশ্বাস করতে পারব কি না নিঃসংশয়ে বলতে পারি না । ।
- কী বলছিলাম ? হা , সে রাত্রে অতিমাত্রায় বিতি হয় দেখলাম , সােনার কাঠি ছোঁয়াতে কুপাের পালঙ্কে যে জেগে উঠল , সে রাজকুমারী কঙ্কাবতী নয় — সে হচ্ছে আমার সেজ বউৰিদির সই নয়নতারা । । — কঙ্কাবতী নয় — হাসিতে মার মুক্তো ঝরে , অশ্রুতে মার হিরে গলে পড়ে , যে চাদের বরন কন্যের মেযের বরন চুল , জেগে উঠতেই যার চোখের দীপ্তিতে সাত মহলে আলাে ঠিকরে পড়ে . সাত সখীতে যাকে চামর দোলায় , যার জন্যে সবাশয় । ও সপ্তসুরের মূর্হনা সােনার কাঠির স্পর্শে তার জায়গায় আমার মুখের দিকে চোখ মেলে চাইলে নয়নতারা , যাকে বিনা উগ্র সাধনাতেই আমি প্রত্যহের কাজে অকাজে রােজই দেখছি । আমাদের বাড়ির কাছেই বােস - পাড়ায় বেলের ধারে তাদের বাড়ি । সামনে পানায় ঢা ছােট একটা পুকুর , তাতে একটা বকুলগাছের ছায়ায় রানাভাঙা সিড়ি নেমে । গেছে । ঘাটর সামনেই খানিকটা দূর্বাঘাসে ঢাকা নি । সেখানে শীতের শােৰে বকুলে । আর সজনে ফুলে কায়ায় - গছে মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকত । তার পরেই একটা । রকের পেছনে নয়নতারাদের বাড়ি - খানিকটা কোঠা , খানিকটা গােলগাতার । মােট । তথা , সাগরতলের প্রবাল - মহলের সঙ্গে তার কোনওই মিল ছিল না ।

। — না ছিল স্বয়ং কঙ্কাবতীর সঙ্গে নয়নতারার কোনও মিল । প্রথমত , নয়নতারা । ছিল কালাে — যা কোনও রাজকন্যারই কখনও হবার কথা নয় । তবুও যে সে সে - রাত্রে আমার গল্পরাজ্যে বিপর্যয় ঘটালে কী করে , তা ভাবতে গেলে আমার মনে পড়ে যায় তার দুটি চোখ । অমন চোখ আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি । তােমরা বােধ হয় স্বীকার করবে ফরসা মেয়ের চেয়ে কালাে মেয়ের চোখই বেশি বাহারে হয় — সবুজ বেষ্টনীর । মধ্যে কালাে জলের মতাে । পরে আমি ভালাে চোখের লােভে অনেক কালাে মেয়ের দিকে চেয়েছি কিন্তু অমন দুটি চোখ আর মেনি । তার বিশেষত্ব ছিল তার অদ্ভুত গীতি ; উগ্র দীপ্তি নয় , তার সঙ্গে সর্বদাই একটা হাসি - হাসি ভাব মিশে থেকে সেটাকে প্রসন্ন করে রাখত । নয়নতারা বেজায় হাসত — বেহায়ার মতাে । যখন হাসত তখন তার কালাে শরীর থেকে যেন আলাে ছড়িয়ে পড়তে থাকত ; যখন হাসত না , আমার মনে হত , তখনও যেন খানিকটা আলাে আর খানিকটা হাসির অবশেষ ওর চোখে লেগে রয়েছে । আমি সে দুটি চোখ বর্ণনা করতে পারলাম না , তা ভিন্ন শুধু চোখ নিয়ে পড়ে থাকলে আমার গল্প শেষ করাও হয়ে উঠবে না । আমি একবার শুধু সে চোখের তুলনা পেয়েছিলাম কতকটা মানুষের মধ্যে নয় , পৃথিবীর কোনও জিনিসেও

নয় — যদি কখনও শীতের প্রত্যুষে উঠে চক্রবালরেখার উপরে শুকতারা দ্যাখাে , তো নয়নতারার চোখের কথা মনে কোরাে ; অর্থাৎ সে অপার্থিব চোখের তুলনা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে স্বর্গের কাছাকাছি । রেলের দিকে দেয়াল - দিয়ে - আড়াল - করা পানাপরের ধারের জায়গাতে নয়নতারার সমবয়সি মেয়েদের আড্ডা জমত । পুরুষের মধ্যে প্রবেশাধিকার ছিল শুধু আমার , কারণ কয়েকটি কারণে আমি ঠিক সেই ধরনের ছেলে ছিলাম নব - পরিণীতাপের যারা খুব কাজে লাগে । প্রথমত , বয়সটা খুব কম ; দ্বিতীয়ত , আমি ছিলাম খুব অভাবী , যার জন্যে বাইরে বাইরে আমায় খুব হালা বলে বােধ হত ; আর তৃতীয়ত , আমার পুরুষ - অভিভাবক না থাকায় বাড়িতে আমার অবসর ছিল সুপ্রচুর এবং ইচ্ছেমতাে পাঠশালার বরাদ্দ থেকেও সময় কেটে অবসর বৃদ্ধি করবার মধ্যেও কোনও বাধা ছিল না । ফলে , ওরা যে আমায় শুধু দয়া করে কাজে লাগাত এমন । নয় , আমি না হলে ওদের কাজ অচল হয়ে যেত । সবচেয়ে বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল চিঠি নিয়ে ; এক কথায় আমি এই সংসদটির ডাক বিভাগের পূর্ণ চার্জে ছিলাম বলা চলে । খাম - টিকিট নিয়ে আসা , চিঠি ফেলে আসা , এমন কি প্রয়ােজন বিশেষয়ে পােস্ট - আপিসে গিয়ে পিয়নের কাছ থেকে আগেভাগে চিঠি চেয়ে নিয়ে আসাও আমার কাজের সামিল ছিল ; আর পাঁচ - সাত জন নবােঢ়ার খাম , টিকিট , চিঠির । সংখ্যার আন্দাজ করে নিতে তােমাদের কোনও কষ্ট হবে না নিশ্চয়ই । এ ছাড়া । বাজার থেকে এটা - ওটা - সেটা এনে দেওয়াও ছিল — চিঠির কাগজ , কালির বাড়ি । মাথার কাটা , ফিতে , চিরুনি . . . আড়ালে ডেকে বলত ,

 ‘ পতি পরমগুরু ' লেখা দেখে । চিরুনিটা নিবি শৈল , লক্ষ্মী ভাই . . . আর এদের সামনে যখন বকবও চিরুনি কেন । মরতে নিয়ে এলি ? ' বলে তখন চুপ করে থাকবি — থাকবি তাে ? . . দুটো পয়সা নিয়ে । ডালপুরী আলুর দম কিনে যেও , যাও ভাগ্যিস শৈল ছিল আমাদের । । এছাড়া সময়ের কাচা ফল , এবং সেগুলিকে তরুণীদের কাঁচা রসনার উপযােগী করবার নানারকম মশলা আহরণ করাও আমার একটা বড় কাজ ছিল । . . রাধানাথ , ও রকম নিশ্বাস ফেললে যে ? হিংসে হচ্ছে । |
 রাধানাথ বলিল , নাঃ , হিংসে কীসের ? এই আমিও তাে আজ তিন ঘণ্টা ধরে গিন্নির ফর্দ মিলিয়ে মিলিয়ে মাসকাবারি কিনে নিয়ে এলাম - মশলা , তেল , ওষুধ , । বার্লি . . . নাও , গল্প চালাও । - সেদিন ঠাকুরমার গল্পে নয়নতারা কঙ্কাবতীর জায়গা দখল করে মিলন - বিরহ , হাসি - কান্না , মান - অভিমানে সমস্ত গল্পটির মধ্যে একটা অপরূপ অভিনবত্ব ফুটিয়ে তুললে । রূপকথা আর সত্যের সে অদ্ভুত মিশ্রণ আমার আজ পর্যন্ত বেশ মনে আছে । সেদিন অরূপকুমারকে বিদায় দিতে কঙ্কাবতীর চোখে যখন মুক্তো ঝরল , তখন আমার সমস্ত অন্তরাত্মা রেলের ধারে সেই বকুলতলাটিতে এসে অসহ্য বেদনাব্যাকুলতা । নিয়ে ভােরের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল । কিন্তু আশ্চর্যের কথা — অবশ্য , এখন আর সেটাকে মােটেই আশ্চর্য বলে ধরি । ১১৫


— তার পরদিন সকাল গেল , দুপুর গেল , বিকেল গেল , সন্ধে গেল , নয়নতারাদের বাড়ির দিকে কোনওমতেই পা তুলতে পারলাম না । কেমন যেন মনে হতে লাগল , কালকের রাত্রের রূপকথাটা আমার চারি দিকে ছড়ানাে রয়েছে — ওদের সামনে গেলেই সব জানাজানি হয়ে যাবে ! এখন লক্ষণ মিলিয়ে বুঝতে পারছি সেটা আর কিছু নয় , নতুন ভালােবাসার প্রথম সংকোচ । — সেজ বউদি বললেন , হ্যা শৈলঠাকুরপাে , আজ সমস্ত দিন তুমি ও - মুখাে হওনি যে ? নয়ন তােমায় খুজছিল । রাত্রি ছিল । আমি লজ্জাটা ঢাকলাম , কিন্তু কথাটা চাপতে পারলাম না , বললাম , যাও , খুজছিল না আরও কিছু ! - সেজ বউদি বললেন , ওমা ! খুজছিল না ? আমি মিছে বললাম ? তিন - চার বার যোভ করেছিল , কাল সকালে যেও একবার । বললাম , আমার বয়ে গেছে । বয়ে গেছে তাে যেও না , আমায় বলতে বলেছিল বললাম । — বলে বউদি চলে গেলেন । সেদিন ঠাকুরমার ছিল একাদশী , গল্প হল না — অর্থাৎ তার আগে রাতে যে । আগুন জ্বলেছিল , তাতে আর ইন্ধন জোগাল না । পরের দিন অনেকটা সহজভাবে নয়নতারাদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম । । - ডেকেছিলে নাকি কাল ? নয়নতারা মুখ তুলে বা গালটা কুঞ্চিত করে বললে , যা যাঃ , দায় পড়ে গেছে । ডাকতে , উনি না হলে যেন দিন যাবে না । দুটো চিঠির কাগজ এনে উপকার করবেন । - ওদের চড়টা - আসটাও মাঝে মাঝে হজম করতে হয়েছে , কিন্তু সেদিন এই কথা দুটোতেই এমন রূঢ় আঘাত দিলে যে , মনের দারুণ অভিমানে বই স্লেট নিয়ে সেদিন । পাঠশালায় চলে গেলাম , মনে বৈরাগ্য উদয় হল আর কি – জানােই তাে পাঠশালাটা । হচ্ছে ছেলেবেলার খাপদ - সংকুল বানপ্রস্থভূমি . . . গুরুমশাই বাঘ , শির - পোেড় ভাঙুক । ইত্যাদি । সেখানে আগের দিন - চারেক অনুপস্থিত থাকবার জন্যে এবং সেদিনও দেরি হবার জন্যে বেশ একচোট উত্তমমধ্যম হল ।
— এর ফলে বাল্য - মােহের কচি শিখাটি প্রায় নির্বাপিত হয়েই এসেছিল , কিন্তু পাঠশালা থেকে ফেরবার পথে যখন রেল লাইন পেরিয়েছি , পুকুরের এপারে রাচিতের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে নয়নতারা ডাকছে আমি প্রথমটা গোজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম , তার পর নয়নতারা আর একবার ডাকতেই আগেকার দু দিনের কথা , সকালের কথা এবং পাঠশালার কথা একসঙ্গে সব মনে হড়ােহুড়ি করে এসে , কী করে জানি না , আমার চোখ দুটা জলে ভরিয়ে দিলে । নয়নতারা বেরিয়ে এসে আমার হাত দুটো ধরে আশ্চর্য হয়ে বললে , ওমা , তুই কাদছিস শৈল ? কেন রে , আয় , চল ।
— বাড়ি নিয়ে গিয়ে খুব আদর - যত্ন করলে সেদিন । দুটো নারকেলনাড়ু আঁচলের

দিয়ে মনটা এমনস শৈল , তুই বিয়সে চুরি করে রেখেs . রাষ্য লুকিয়ে নিয়ে এসে বলল , তাের জন্যে চুরি করে রেখেছিলাম শৈল , খা । তোকে ত্যি বড় ভালােবাসি শৈল , তুই বিশ্বাস করিনি । তোকে বার মাথায় তায়ে য়ে মনটা এমন দুস্থ করছিল । মুখে আগুন নাস্তের অত খােশামােদ করিয়ে , একটা টাইয়ের দাম আদায় করে যদিবা কালকে চিঠির কাজ দিলে এনে , আজ কোনও এতেই চিঠিটা ফেলে দিলে না রে । গলে যাক অমন দশমন শতর - বেইমানের । এদিক - ওদিক একটু চেয়ে শেমিজের মধ্যে থেকে একটা গোলাপি খাম বের সুর মিনতির সুরে বললে , সত্যি তােকে বড় ভালােবাসি শৈল — বললে না পেতাম যাবি ।

 . . এই চিঠিটা ভাই , বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে নে । আর এক ঘরে পােস্ট - আপিসে ফেলে দিয়ে বাড়ি যেও ; রোদটা একটু কড়া , কষ্ট হবে ? হ্যা , শাৈলকার আবার এ কষ্ট কষ্ট ' নন্তে কিনা ! এগারােটা বেজে গেছে ; বারােটার সময় ডাক বেরিয়ে যাবে শৈল , ল — আমি এখনও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি — পুরধারে , শানের বেঞ্চের পেছনে । বকুলগাছের আড়ালে আমার কাধে বাঁ হাতটা দিয়ে নয়নতারা দাঁড়িয়ে আছে । আমার মুখের ওপর ডাগর ভাসা - ভাসা চোখ দুটি নিচু করে তাতে চিঠির গােপনতার একটু লজা , খােশামােদের ধুর্তামি , বােধ হয় , একটু অনুতপ্ত স্নেহ , আর একটা জিনিস - - একটা অনির্বচনীয় কী জিনিস , যা শুধু নবপরিণীতাদের চোখেই দেখেছি , আর যা এই রকম চিঠি লেখা , চিঠি - পাওয়ার সময় যেন আরও বেশি করে ফুটে ওঠে । — এইখানে আমার ভালােবাসার ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় শেষ হল এই ফিরে যেতে যেতে আবার ঘুরে আসায় । তােমাদের ওই বয়সের মেয়েদের মজলিশের । কোনও অভিজ্ঞতা আছে ? তারাপদ বলিল , না । রাধানাথ বলিল , কী করে থাকবে বলাে ? গার্জেনের কণ্টকারণে মানুষ হয়েছি । চক্ষ সর্বদা বাইরে অক্ষয় - লগ্ন কথা থাকত , অক্ষরের রূপে যে যুদ্ধ ছিলাম তা নয় , বই থেকে চোখ তুললেই বাবা কিংবা পাঁচ কাকার কেউ - না - কেউ চোখে পড়তেন । দুটিছাটায় যদি দু - এক জন বাইরে গেলেন তাে সেই ছুটির সুযােগে মামা - পিসেমশাইদের । দল এসে আমার ভবিষ্যতের জন্যে সতর্ক হয়ে উঠতেন । তারা ছিলেন উভয় পক্ষ । মিলিয়ে সাত জন । শেষে এই তেরাে জনে মাথা একত্র করে বিয়ে দিলেন এমন একটি নিষ্কণ্টক মেয়ের সঙ্গে , যার বাপের সম্পত্তিতে ভাগ বসাবার জন্যে না - ছিল বােন , - ছিল একটা ভাই যে , একটি শালাজেরও সম্ভাবনা থাকবে নাও , বলে যাও । আবার মজলিশ ! এত কড়াকড়ির মধ্যে যে একটি মেয়ে কোনও রকমে ঢুকে পড়েছে এই ঢের । |

 তারাপদ বলিল , রাধানাথ চটেছে । তা চটবার কথা বইকি । শৈলেন বলিল , নয়নতারাদের মজলিশের কথা বলতে যাচ্ছিলাম । আগে বােধ হয় এক জায়গায় বলেছি যে , এ মজলিশে আমি মুক্তগতি ছিলাম । ছাড়পত্র ছিল বটে , ও এর পর্বে আমি তার পর্ণ সদ্ব্যবহার করতাম না । তার কারণ ওদের কথা সব । শৰ ঠিকমতাে বঝতামও না , আর বুঝলেও সব সময় সুস পেতাম না । আমার


পুরো গল্পটির জন্য নিচে দেওয়া লিংকটিতে ক্লিক করুন।

ক্লিক করুন।

Post a Comment

0 Comments