বরযাত্রী
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প: বরযাত্রী
শ্রেষ্ঠ গল্প
নাচনের বিবাহ। বরযাত্রীদের মধ্যে রাজেন, কে, গুপ্ত, গোরাচাঁদ আর ঘোনা
সিয়া হাজির হইয়াছে, গণশার অপেক্ষা; সে আসিলেই এদিককার দলটা পূর্ণ হয়।
বিলােচন সাজ-গােজের মধ্যে এর পূর্বেও আসিয়া কয়েকবার খোঁজ লইয়া গিয়াছে,
আবার তর্জনীর উগায় একটু স্নাে লইয়া মুখ বাঁকাইয়া দক্ষিণ গালটা নির্মমভাবে
ঘিতে ঘষিতে আসিয়া হাজির হইল; প্রশ্ন করিল, এল র্যা ?
| ঘোঁৎনা বলিল, ওর মামা ওকে যে রকম আগলে বসে আছে দেখলাম—
| এমন সময় হালদারের বাড়ির পাশের গালিটায় সাইকেলের ঘণ্টির আওয়াজ
হইল, এবং গণশা সবেগে নিষ্ক্রান্ত হইয়া এবং সবেগেই দলটির মাঝখানে প্রবেশ
করিয়া ব্রেক চাপিয়া নামিয়া পড়িল। জবাবদিহি হিসাবে বলিল, গণশাকে আটকায়।
সে এখনও মা-ম্মায়ের পেটে।।
| ছােকরা একটু তােতলা; রাগিলে কিংবা উৎসাহিত হইলে এক একটা অক্ষর প্রায়
দ্বিত প্রাপ্ত হয়। ডানদিকের ভূটায় একটা হেঁচকা টান দিয়া সামলাইয়া লয়।
রাজেন বলিল, তাের কিন্তু না গেলেই ভালাে হত গণশা। এতদিন হাঁটাহাঁটি করে
সাহেব যদি বা ইন্টারভিউয়ের জন্যে আজ ডাকলে, বরযাত্রী যাওয়ার লােভে
| ঘেন্না বলিল, তাতে আবার আজকাল চাকরির যা বাজার!
গণশা বলিল, তিলুর বিয়েতে আমি যাব না! এরপর আমার নি-নিজের বিয়েতে
বলবি, গ-গণশা তাের গিয়ে কাজ নেই, তুই চা-চাকরির খোঁজ করগে।।
গণেশের কথাটা বলিবার হক আছে। সে ত্রিলােচনকে তাস খেলিতে শিখাইয়াছে,
সিগারেট খাইতে শিখাইয়াছে, চলন্ত ট্রামে উঠা-নামা করিতে শিখাইয়াছে এবং নিয়মিতভাবে
বায়স্কোপের সিরিয়ালে-অসিরিয়ালে লইয়া গিয়া পৃথিবীর যত সিনেমা-জ্যোতিষ্কদের।
নাম মুখস্থ করাইয়া তাহাকে সকল দিক দিয়া লায়েক করিয়া তুলিয়াছে।
শুধু তাই নহে। আপাতত এ কয়েকদিন ধরিয়া দাম্পত্যনীতিতে জোর তালিম
দিতেছে সেই, এবং বিশেষ করিয়া দাম্পত্য-রাজ্য করায়ত্ত করিবার পূর্বে বাসর-দুর্গটি
কী করিয়া অতিক্রম করিতে হইবে, তাহারও কৌশল-কানুন অধিগত করা হইতেছে
ওই গণশারই নিকট। ত্রিলােচন কৃতজ্ঞচিত্তে বলিল, না না, ।
না, এসে ভালােই করেছিস।
বউদি আবার বাসরঘরের যা ভয় লাগিয়ে দিয়েছে, ভাবছি, আর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে
আর জল খাচ্ছি। যার সঙ্গে বিয়ে, সে একলাটি থাকলেই দিব্যিটি হত। কার কথার।
এ কী উত্তর দেব, কার কানমলা সামলাব, কে গোঁফজোড়াটা নেড়ে দেবে, তার ।
ওপর আবার গানের ফরমাশ আছে, কারুর হেঁয়ালি আছে।
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় উপন্যাস
জোড়াটা নয় ফেলে দেব
| কে. গুপ্ত ত্রিলােচনের পাশাপাশি তাদের ফুটবল-টিমে ব্যাক খেলে। বলিল।
বটে; পাঁচটা ফরওয়ার্ডকে সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যেতে হয়—
ত্রিলােচন বলিল, দুজনে মিলে, আর এ একলা। গোফজোড়াটা নয় ফেলে
গণশা, যতটা হালকা হয়। বিয়ে হয়ে গেলে আবার না হয় তখন
গােরাচঁাদ বলিল, তা হলে তাে নাক কান কেটে, মাথা মুড়িয়ে বাসরঘরে
হয়।
হা মডিয়ে বাসরঘরে ঢুকতে
| গণশা বলিল, বরং ক-কন্ধকাটা হয়ে ঢুকলে তাে আরও ভালাে হয়। দে।
বরের গগ গলারই বালাই নেই, গাইতে বলা মিছে।
ত্রিলােচন চিন্তিতভাবে বলিল, তােদের তামাশা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার
এদিকে যে কী হচ্ছে তা—আবার তার ওপর সকাল সকাল লগ্ন পড়ে গেছে কপালগুখে ।
| কে, গুপ্ত বলিল, খুব স্টেডি থাকবেন মশাই, নার্ভাস হলেই প্রেস করে ধরবে।
একটা বড় দেখে নিতবর সঙ্গে নিলে—
| গণশা একটু রাগিয়া উঠিল; বলিল, বা-ব্বাড়ির দারােয়ান কি গা-গগাড়ির সহিসকে
তাে আর নিতবর করবে না মশাই; সে সব আপনাদের ছা-চছাতুর দেশে চলে।।
| বেহারের ছেলে। সুদুর ছাপরার এক মহকুমার স্কুল হইতে পাস করিয়া কলকাতার।
কলেজে পড়িতে আসিয়াছে, বাংলার ছেলেদের সঙ্গে এখনও কথায় পারিয়া উঠে না।।
কে. গুপ্ত চুপ করিয়া গেল।
_ ঘোঁৎনা বলিল, বাসরঘরের ভয়ে যদি বিয়ে ছাড়তে হয় তাে কলিশানের ভয়ে।
গাড়ি চড়াও ছাড়তে হয়। গােরাচাদের কথাবার্তায় প্রায়ই একটু আহার্যের গন্ধ থাকা।
নিয়ম; বলিল, তা হলে কাটার ভয়ে মাছ খাওয়া ছাড়তে হয়।।
কবি রাজেন বলিল, কণ্টকের ভয়ে গােলাপফুল ছাড়তে হয়।
গণশা সাইকেলটা রাখিতে গিয়াছিল, আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বরযাত্রীদের মালা
এসেছে?
ত্রিলােচন বলিল, সে সব ঠিক আছে—মালা, গােলাপজল, এসেন্স। আর আমি
যাই, দেখিগে, সবাই একটু মিষ্টিমুখ করে যাবি তাে ?
| গােরাচঁদ বলিল, হ্যা, যা, শিগগির যা। কী কী আছে র্যা ?
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় pdf
ত্রিলােচনকে ফিরাইয়া ঘোঁৎনা বলিল, আর শােন। ওদিকে কে কে যাচ্ছে বল।
তাে, বেশি ভেজাল বাড়ালে আবার ফুর্তি জমবে না।
| ত্রিলােচন বাঁ হাতের আঙুলের পর্ব গুনিতে গুনিতে বলিল, বাবা এক, মেসাে দুই,
সেজপিসে, সহায়রামবাবু, এই হল চার, আর আর-
বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ কে. গুপ্ত ভয়ে ভয়ে মনে করাইয়া দিল, একজন
পুরুত যাবে না?
| ত্রিলােচন গুনিল, পুরুত পাঁচ, দীনে নাপতে ছয়। পুরুতমশাই নিজে যেতে।
পারবেন না, তার কাকা ন্যায়রত্ন মশাই যাবেন।
| গােরাচাঁদ একটু অস্বস্তির সহিত বলিল, এই ছজনেও মিষ্টিমুখ করবে তাে।
তার ওপর; কার সঙ্গে ২
বেনা বলিল, পুরুত-ঠাকুরের কাকা? সে বুড়াে তাে রাতকানা, আবার কালাও।
বে, কার সঙ্গে বিয়ে দিতে কার সঙ্গে দিয়ে দেবে!
বিলচুন বলিল, তাকে দীনে সামলাবে।
দেন বলিল, একা দানে ব্যাটা ক'জনকে সামলাবে ? ওদিকে সহায় রাম চাটুজোর।
গাওয়া মানেই বােতলের শ্রাদ্ধ ।
| বিলােচন বলিল, সহায়রামবাবু আর সেজপিসে রাত্তিরেই চলে আসবে; কাল
তর আপিসের মেল-ডে কিনা, ছুটি পেলে না। আর বােতল? দু পাট সাফ হয়ে।
গেছে, দু-ডজন চপ কাটলেট
(গারাচাদ বিরক্ত হইয়া বলিল, কেন মিছিমিছি তিলকে আটকাচ্ছিস সবাই ?
গােজে দেরি হয়ে যাবে, ভালাে করে একটু সাজাতে হবে তাে? কথায় বলে
বরসজা। ওই সঙ্গে কিছু চপ কাটলেট সরিয়ে ফেলগে ত্রিলােচন, ট্রেনে কাজ দেবে।
উপর হইতে ছােট বােন ডাকিল, দাদা, গল্প করছ, জামাকাপড় পরতে হবে না?
বউদি চন্দন-টন নিয়ে বসে আছেন যে!
| গােরাচাদই উত্তর দিল, তােমাদের সব তাড়াতাড়ি। ত্রিলােচনের গেঞ্জিতে একটা
টান দিয়া বলিল, আগে গিয়ে কী যেন মিষ্টিমুখের কথা বলছিলি, দেখে শুনে দিগে।
তাড়াতাডিতে ভুলে গেলে তাের মার মনে আবার শুভদিনে একটা খটকা থেকে
যাবে। ও সাজগােজের জন্যে ভাবিসনি, আজকাল আবার মেলা সাজগােজ করাটা
ফ্যাশান নয়, না রে গণশা?
গণশা বলিল, তা বইকি, আজকাল যত—
ত্রিলােচন পা বাড়াইল! গণশ হঠাৎ সামলাইয়া লইয়া বলিল, মা-মালা গােলাপজল,
এসেন্স পাঠিয়ে দিগে, আর আমার জন্যে একটা সিল্কের রুমাল আর ভা-ালো শাল
পারিস তাে, পা-প্পালিয়ে এসেছি কিনা, আর দ্যাখ
ত্রিলােচন দরজার নিকট ফিরিয়া দাঁড়াইতে গণশ। বাঁ হাতটা তুলিয়া সিগারেটের
টিন আটে এই পরিমাণ একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি মুদ্রা সৃজন করিয়া বলিল, বা-ব্বাগিবি
একটা।।
উত্তরে ত্রিলােচন বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দুইটা তুলিয়া ধরিয়া
হাসিয়া সংক্ষেপে বলিল, সে হয়ে গেছে-এই।
| গণশা বিরক্ত হইয়া গােরাচাদের দিকে চাহিয়া বলিল, বে-চোরা বিয়ের সময়
একটু সাজগােজ করবে না তাে ওর দিদিমাকে গঙ্গাযাত্রা করবার সময় করবে?
খ্যাটের গন্ধ পেলে তাের জ্ঞান থাকে না গােরে। আমায় আবার সা-সাক্ষী মানতে
কে বলেছিল র্যা ? একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, অমনই; না রে গণশা?।
যেখানে বিবাহ সে গ্রামটার মূল নাম গােকুলপুর; পরে ‘কালসিটে গােকুলপুরে
পাড়ায়। কবে নাকি গ্রামের লােকেরা এক মাতাল গােরার দলকে উত্তম-মধ্যম দিয়া।
ল হইয়া এখন শুধু কালসিটের
৪ গ্রামে কোনও বরযাত্রী
। যার নাম কালসিটে
এই সামরিক খেতাবটা অর্জন করে। মুখে মুখে ক্ষয় প্রাপ্ত হইয়া এ
দাঁড়াইয়াছে।।
| বরযাত্রীর দলও প্রায় গােরার মতােই শক্রস্থানীয়, তাই গা
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প pdf download
আসিলেই ছেলে ছােকরারা সুযােগমতাে কানে তুলিয়া দেয়, এ যার
মশাই, একটু সমঝে চলতে হবে।
গ্রামটা ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি, স্টেশন হইতে মাইল তি
বাড়িটা নিবিড় জঙ্গলে ঢাকা। গ্রামের সব বাড়িই এই রকম। হে
৪তে মাইল তিন-চার দূরে।
সব জল টইটুম্বুর।
পরই ঘন সতেজ পানার কার্পেট।।
ইবে। উৎসব উপলক্ষে
। শামিয়ানার চারিদিকে খুঁটিতে
বা. দই-একটা মাঝারি সাইজের পুকুরও আছে, সব জল ১৯
জলটা ঘাটের কাছে একটু দেখা যায়, তাহার পরই ঘন সতেজ পানাৰ
সদর আর অন্দর আলাদা আলাদা, রশি দুয়েকের তফাত হইবে। উৎসব
সদর-বাড়ির সামনে একটি ছােট শামিয়ানা পড়িয়াছে। শামিয়ানার চারিদিকে
কাচের পাত্রে মােমবাতির নিষ্প্রভ আলাে, মাঝখানে একটি তীব্রজোনি,
আলাে-বকমধ্যে হংস যথা শােভা পাইতেছে। অন্দর-বাহির মিলিয়া আরও ...।
কতক গ্যাসের আলাে।।
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় জীবনী
| শামিয়ানার মধ্যে বরের আসর। বর বিষন্নমুখে বসিয়া আছে এবং দূরে পাড়ায়
কোনও মেয়ের দল বাড়ির মধ্যে যাইতেছে দেখিলেই বাসরঘর স্মরণ করিয়া অটজাত
বলিতেছে, বাপ রে, দফা সারলে আজ!
তাহাকে ঘেরিয়া তাহার বন্ধু বর্গ। সবচেয়ে কাছে গণশা, একটা মখমলের বালিশ
বুকে চাপিয়া ত্রিলােচনের দিকে ঝুঁকিয়া বসিয়া আছে। মাঝে মাঝে ত্রিলােচনও মখট।
বাড়াইয়া আনিতেছে, এবং একটু কথাবার্তা হইতেছে।
একটু দূরে কর্তারা। বলা বাহুল্য, সকলেই অপ্রকৃতিস্থ কম-বেশি করিয়া। সহায়রামবার।
কন্যাত্রীদের কয়েকজনের সঙ্গে বেশ জমাইয়া লইয়াছেন। তাহার বক্তব্য, তিনি।
কতশত জায়গায় বরযাত্রী গিয়াছেন, কিন্তু এমন ভদ্র কন্যাপক্ষ কোথাও দেখেন নাই।।
নানা রকম উদাহরণ দিয়া অশেষ প্রকারে কথাটা সাব্যস্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন,
কিন্তু মুশকিল, তাহারা কোনও রকমেই কথাটা মানিয়া লইতে প্রস্তুত নয়। তাহাদের।
মধ্যে সব অল্পবিস্তর নেশা করিয়াছে এবং ধরিয়া বসিয়াছে, তাহার অতি দীনহীন ইতর;
বরপক্ষীয়েরাই বরং অতিশয় ভদ্র ও সম্মানাহ্, এ গ্রামে এ রকম বরযাত্রী আসে নাই।
কথাটা অমায়িক মৃদু-হাস্যে, হাতজোড় প্রভৃতি বিনয়ােচিত প্রথায় আরম্ভ হইয়াছিল।
ক্রমেই কিন্তু সে ভাবটা তিরােহিত হইয়া যাইতে লাগিল, এবং একটা জেদাজোদর।
সঙ্গে সবার মুখ গম্ভীর হইয়া আসিতে লাগিল। ত্রিলােচনের পিসে একটু উষ্ণ হন।
জড়িত স্বরে বলিলেন, কেমনতর লােক আপনারা মশাই ? একটা ভদ্রলােক
থেকে বলছে, আপনাদের মতাে ভদ্রলােক দেখিনি, তা কোনওমতেই মানবেন ।
ভারী জ্বালা তাে!
| ওদিককার একজন তারই মতাে ভারী আওয়াজে উত্তর করিল, আর আমা
কথাটা বুঝি কিছু নয় তা হলে মশাই? আমরা এতগুলাে ভদ্রলােক মি
লাে ভদ্রলােক মিথ্যাবাদী হলাম?
পরবর্তী পার্ট আসছে.....
#বিভূতিভূষণমুখোপাধ্যায়উপন্যাস
#বিভূতিভূষণমুখোপাধ্যায়শ্রেষ্ঠগল্পpdfdownload
ডাউনলোড করুন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প সমগ্র পিডিএফ ফাইল।
PDF format download
0 Comments